শিরোনাম
১৯৭২ সালের সংবিধানের ত্রুটি ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত *** আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার সুযোগ নাই - নাহিদ *** নেটিজেনদের প্রশংসায় ভাসছেন তারেক রহমান *** শহীদি মার্চে ছাত্র-জনতার ঢল *** সিডনিতে রোজল্যান্ডস ওয়ার্ডের জন্য মোহাম্মদ জামানের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু ***




↠ফারজানা মাহমুদ


১৪ অক্টোবর, ২০২১

মতামত › জাতীয়

মন্তব্য:০

News Picture

চিত্র:bd| |ক্রেডিট : AP

নির্বাচন কমিশন গঠন

নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হচ্ছে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নতুন নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হবে তা নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলসমূহ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮ (১) এ বলা হয়েছে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশে একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন’। উল্লেখ্য, ২০১২ এবং ২০১৭ সালে যথাক্রমে বাংলাদেশের প্রয়াত মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং আবদুল হামিদ প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের লক্ষ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের উদ্দেশ্যে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘সার্চ কমিটি’ ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আইন নেই। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত,যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত, সেখানেও নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত কোনও আইন নেই। ভারতীয় সংবিধানের ৩২৪ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যেরূপ নির্দেশ করেন সেরূপ সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের সমন্বয়ে ভারতের নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে এবং এই সংক্রান্ত প্রণীত কোনও আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারকে নিয়োগ দান করবেন। যদিও পাকিস্তান গণতন্ত্রের জন্য আদর্শ কোনও উদাহরণ নয়; ২০১০ সালে পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধনের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতেন। ২০১০ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের ১৮তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টারি কমিটিতে বিরোধী দল এবং সরকারের মধ্যে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেন। এরপরও এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হতে পারেনি। বাংলাদেশে সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশনারদের যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক চলছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, যদিও বাংলাদেশের তথ্য কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নয়, সেখানেও প্রধান তথ্য কমিশনার ও অন্যান্য তথ্য কমিশনার নিয়োগের সুপারিশ প্রদানের জন্য ৫ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি রয়েছে (তথ্য অধিকার আইন ২০০৯), যারা প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুই জন ব্যক্তির নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করেন। রাষ্ট্রপতি বাছাই কমিটির সুপারিশক্রমে প্রধান তথ্য কমিশনারসহ অন্যান্য তথ্য কমিশনারকে নিয়োগ দেন। ঠিক একই পদ্ধতির আলোকে ২০১২ এবং ২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। যেখানে বিচার বিভাগ,নির্বাহী বিভাগ এবং সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। এই কমিটি কমিশনারদের নিয়োগের জন্য প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুজনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করেন এবং রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। ২০২২ সালে গঠিতব্য নির্বাচন কমিশনের কমিশনারদের নিয়োগ কীভাবে হতে পারে এবং সার্চ কমিটি কাদের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে তার জন্য সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) একটি খসড়া আইন প্রস্তাব করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, সার্চ কমিটি কমিশনের নিয়োগ দেওয়ার লক্ষ্যে যোগ্যতা ও গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুসন্ধান করবে এবং একই সঙ্গে নাগরিকদের নিকট থেকে নাম আহ্বান করবে। তারপর প্রাপ্ত নামগুলো থেকে ন্যূনতম ৫ জন নারীসহ ২০ জনের একটি প্রাথমিক তালিকায় তাদের যোগ্যতা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করবে। সুজনের প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, প্রাথমিক তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্কে অনুসন্ধান কমিটি গণশুনানির আয়োজন করবে, তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করবে এবং কমিটির সর্বসম্মতিক্রমে ন্যূনতম ২ জন নারীসহ ৭ জনের একটি প্যানেল প্রস্তুত করবে। এ প্রস্তাবিত আইনের খসড়া পড়ে বোধগম্য হয়নি অনুসন্ধান কমিটি ‘কোন নাগরিকদের’ কাছ থেকে কমিশন নিয়োগের জন্য নাম অনুসন্ধান করবে। বাংলাদের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিক অর্থ নাগরিকত্ব সম্পর্কিত আইন অনুযায়ী যে ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশের সব নাগরিকের কাছ থেকে নাম আহ্বান করা অসম্ভব ব্যাপার, তাই ‘নাগরিক’ বলতে সুজন কাদের বুঝিয়েছে তা অস্পষ্ট ও প্রশ্নবিদ্ধ। সুজন আরও প্রস্তাব করেছে প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধান তালিকায় যারা থাকবেন তাদের নাম গণবিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হবে। বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন গণবিজ্ঞপ্তি এসব প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের জন্য কতটা সুখকর অভিজ্ঞতা বয়ে নিয়ে আসবে তাও বিবেচ্য। সুজনের প্রস্তাব অনুযায়ী কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য যাদের নাম প্রাথমিক তালিকায় থাকবে তাদের ব্যাপারে গণশুনানির আয়োজন করা হবে। আবারও প্রশ্ন আসে এই গণশুনানিতে কারা অংশগ্রহণ করবেন এবং তাদের যোগ্যতা কী? সুজন প্রস্তাবিত খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের পরের মেয়াদ থেকে কমিশনের কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষায় পূর্ববর্তী কমিশনের জ্যেষ্ঠতম কমিশনারকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হবে, যদি না তিনি কোনও দুর্নীতি এবং অসদাচরণে জড়িত থাকেন। এই নিয়োগের ক্ষেত্রেও অনুসন্ধান কমিটির সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন তৈরিকৃত প্যানেল চূড়ান্ত প্যানেল হিসেবে গণ্য হবে এবং রাষ্ট্রপতি তা বাতিল না করা পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় জ্যেষ্ঠতার সংজ্ঞা নিয়োগের ওপর ভিত্তি করে না বয়সের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। অনুসন্ধান কমিটির মেয়াদকাল পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত নয়। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা রয়েছে, কোনও নির্বাচন কমিশনারের পদের মেয়াদ কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে পাঁচ বছরকাল। এখানে সুজন কেন ইচ্ছা প্রকাশ করছে যে তাদের প্রস্তাবিত আইনের অধীনে তৈরিকৃত প্যানেল চূড়ান্ত প্যানেল হিসেবে গণ্য হবে এবং সেটি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকবে তা পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ সংক্রান্ত আইন করা যেতেই পারে। তবে তা হতে হবে কার্যকর। সেই কার্যকর আইন প্রণয়নের জন্য বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতাকে অব্যাহত রাখার জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেমন একটি দক্ষ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন দরকার তেমনি নির্বাচন কমিশনের কাজকে বেগবান করার জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং নির্বাচন কমিশনারদের ভেতরে একটা মেলবন্ধন থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতার জন্য যেমন সরকারি দলের দায়িত্ব রয়েছে তেমনি বিরোধী দলেরও ভূমিকা রয়েছে। নির্বাচনে পরাজিত হলে নির্বাচন ব্যবস্থাকে দোষারোপ করা বা নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা গণতন্ত্র বিকাশে সহায়ক নয়। লেখক: (ব্যারিস্টার) আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। মানবাধিকার কর্মী।





মন্তব্য