১৪ অক্টোবর, ২০২১
মতামত › জাতীয়
মৃতের মিছিল দিনদিন বাড়ছে। বাড়ছে আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আর ধৈর্য পরীক্ষা। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে অনেকের পরিবারের সদস্যদের, বন্ধুদের, পরিচিতজনের (আমার না হলেও অন্যদের) মৃত্যুর ভয়ঙ্কর খবর দেখার ভয়ে আমি ভীত। তরুণ বা বৃদ্ধ, যে-ই মারা যাক না কেন, সে নিশ্চয়ই কারো কাছের বা প্রিয়জন। তবুও, সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমাকে সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম চেক করতে হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর অসীম রহমতে নিজ সৃষ্টিকে জীবনদান করেছেন। তিনিই আবার সেই জীবন ফিরিয়ে নেন এটা জেনেই যে, তা মৃতের ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয়জনদের জন্য প্রচণ্ড যন্ত্রণার কারণ হবে। তাই তিনি আমাদের সেই কষ্ট এবং যন্ত্রণা সহ্য করে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য ক্ষমতা উপহার দিয়েছেন যে কারণে আমাদের ডাক আসার আগে আমরা আরেকটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারি। ২০২১ সালের ২১ আগস্ট আমরা একজন কোর্সমেট, একজন সাথী মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের প্রিয় বন্ধু মেজর মুক্তাদির আলিকে হারালাম। যা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত কারণ তিনি স্বাস্থ্যকর এবং ঝামেলা মুক্ত জীবনধারা বজায় রেখেছিলেন। আমরা তার মৃত্যুশোক সইবার অনেক আগে, ২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আমাদের আরেক কোর্সমেট, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আকবর ইউসুফের মৃত্যুর খবরে হতবাক হয়ে পড়ি, যিনি একজন সাথী মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি আমাদের প্রিয় বন্ধুও ছিলেন। আকবর ইউসুফের ব্যক্তিগত জীবনের ট্র্যাজেডির মাধ্যমে এই জাতি স্বাধীনতার জন্য যে আত্মত্যাগ করেছে তার গভীরতা এবং বিশালতার প্রতিফলন ঘটে। এটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেই নিষ্ঠুর বর্বরতার বহিঃপ্রকাশ যারা আমাদের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কবরচাপা দিয়ে রেখেছিল। মেধাবী ছাত্র আকবর ইউসুফ, অন্য সব যুবকের মতই খুঁজছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে 'ডিসটিংশন' সহ এইচএসসি পরীক্ষা পাস করার পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (EPUET যা এখন BUET) এ ভর্তি হন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যাপকভাবে জয়লাভ করে, এরপর পাকিস্তানি সামরিক-রাজনৈতিক চক্র একদিকে বাঙালিদের রাজনৈতিক ক্ষমতা অস্বীকার করার ষড়যন্ত্র শুরু করে, আর অন্যদিকে শুরু করে গণহত্যা। বাঙালিদের উপর বিক্ষিপ্ত আক্রমণে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাজধানীতে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, নিরীহ মানুষ, পুলিশ, প্রাক্তন ইপিআর সদস্য, সাধারণ নারী-পুরুষ এবং শিশু সহ হাজার হাজার মানুষ নিহত হলে নিজের পরিবারের সাথে থাকার জন্য আকবর ইউসুফ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলে যান। চট্টগ্রামের নিরাপত্তা পরিস্থিতিও তেমন ভালো ছিল না, অবাঙালি বিহারিরা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে হাত মেলায়। এটা চরম যন্ত্রণাদায়ক যে, বিহারিরা ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের পর স্থানীয় প্রতিশোধ থেকে নিজেদের বাঁচাতে এবং নিরাপদ আবাসের খোঁজে শরণার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল, কিন্তু তাদের অভ্যাসগত বিশ্বাসঘাতকতায় তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে সেইসব লোকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, যারা তাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়েছিল। পরিস্থিতি যে গুরুতর তা অনুমান করে আকবর ইউসুফের পুরো পরিবার (বাবা, মা, ছয় ভাই, এক বোন, সাথে এক চাচা) চট্টগ্রাম ছেড়ে তাদের গ্রামের বাড়ি মীরসরাইয়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যেই ভাবনা সেই কাজ। পরিবারটি ০৬ এপ্রিল একটি রাস্তা ধরে (যেটি বিহারি কলোনি ছুঁয়ে গেছে) হেঁটে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। আকবর ইউসুফ (তার ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে), তার অন্য দুই ছোট ভাই এবং চাচা অন্য দলটির থেকে কিছুটা এগিয়ে ছিলেন। পিছনের দলটি তাদের ধরতে না পারায়, আকবর ইউসুফ পিছন ফিরে তাকিয়ে থামলেন এবং দেখতে পেলেন তারা একদল সশস্ত্র বিহারি দ্বারা বেষ্টিত। আসন্ন বিপদ আঁচ করতে পেরে আকবর তাদের উদ্ধার করতে ফিরে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার বাবা তাকে ইশারা করেন ফিরে না আসার জন্য এবং তাদের গন্তব্যে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আকবর নিজের অর্ধেক পরিবারকে পিছু ছাড়ার মতো মানুষ ছিলেন না। তিনি তার চাচাকে না থেমে সামনে এগুতে প্ররোচিত করেন। বিহারিদের দ্বারা আটক দলটির সাথে কি ঘটছে তা দেখার জন্য তিনি একটি লম্বা গাছে চড়ে বসেন। তিনি নিজের চোখে দেখেন কিভাবে মানুষরূপী হায়েনারা একের পর এক তার বাবা, মা, দুই ভাই এবং বোনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে উন্মাদ হয়ে আকবর গাছ থেকে নেমে গেলেন এবং ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া শুরু করেন। কিন্তু তিনিও তাদের পরবর্তী শিকার হতে পারেন এই ভয়ে আশেপাশে জড়ো হওয়া গ্রামবাসী তাকে বাধা দেয়। হতাশাগ্রস্ত এবং তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় আক্রান্ত আকবর পরবর্তী মাসটি কী করবেন তা না জেনেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি যখন ধীরে ধীরে শান্ত হন, তখন তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিশোধ নেওয়ার এবং দেশকে মুক্ত করার যুদ্ধে যোগ দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলেন। তিনি তার এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করেন এবং শিগগিরই সীমান্ত অতিক্রম করে মেজর রফিক, বিইউ এর অধীনে ১ নং সেক্টরে যোগদান করেন। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের পর তিনি গেরিলা দলে যোগ দেন যা পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক আক্রমণাত্মক অভিযান পরিচালনা করেছিল, যেগুলোর মধ্যে কয়েকটি ছিল বেশ চিত্তাকর্ষক এবং উল্লেখযোগ্য। তার নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, সাহস উর্ধ্বতনদের মুগ্ধ করে এবং তাকে মুক্তিবাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আকবর জলপাইগুড়ি জেলার অধীনে সিকিম ও ভুটানের মধ্যবর্তী এক ভারতীয় পাহাড়ি উপত্যকা মুর্তিতে একটি অস্থায়ী অফিসার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তিন মাসের ক্র্যাশ কোর্সের জন্য ৬৯ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ক্যাডেটদের (যা ২য় বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স- বিডব্লিউসি -২ নামে পরিচিত) একটি ব্যাচে যোগ দেন। এই লেখক নিজেও বিডব্লিউসি -২ এর সদস্য ছিলেন এবং আকবরের সাথে তার বেশ ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। শিগগিরি আকবরের সাথে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডির কাহিনী অন্যান্য ক্যাডেটরা জানতে পারলে তারা তার প্রতি নিজেদের সহানুভূতি প্রকাশ করেন। কিন্তু প্রত্যেকেই সতর্ক এবং সংবেদনশীল ছিলেন এই ভেবে যে ঘটনাটি তার সামনে উঠালে অথবা কোন কৌতূহল দেখালে এটি তার গুরুতর যন্ত্রণাকে পুনরায় জাগিয়ে তুলতে পারে যা ছিল তার অন্তরে অন্তর্নিহিতভাবে সমাহিত। কিন্তু অধিক মর্যাদাপূর্ণ, সাহসের এবং তার বশীভূত মানসিক, আবেগগত এবং নৈতিক শক্তির প্রকাশ ছিল এই বিষয়টি যে তিনি বাহ্যিকভাবে যন্ত্রণায় ভুগছিলেন না বা কোন সহানুভূতি কামনা করছিলেন না এবং কীভাবে তিনি নিজের ভেতরের যন্ত্রণাকে দমন করছিলেন ... তিনি বিষয়টি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত রেখেছিলেন এবং যদি তিনি কাঁদতেনও তবে সেটি ছিল নির্জনে, জনসমক্ষে নয়। এর বিপরীতে, আমাদের প্রশিক্ষণের সময়, যা কিছু ছিল ভয়াবহ, শারীরিকভাবে কঠিন, হাড়-চূর্ণ পরিশ্রমের এবং বাস্তবিকই ধৈর্যশক্তির পরীক্ষা, সেসব চ্যালেঞ্জিং কাজে অংশগ্রহণ করতে আকবর সর্বদা সবচেয়ে সক্রিয় এবং উতসাহী ছিলেন। আকবর ছিলেন স্বভাবজাতভাবেই আন্তরিক এবং হাসিখুশি। গান গেয়ে এবং বাঁশি বাজিয়ে তিনি সম্ভবত সান্ত্বনা খুঁজতেন।
মন্তব্য:০